ক্রীতদাসের হাসি
।।আধুনিক বাংলাসাহিত্যের একজন শক্তিশালী কথাশিল্পী শওকত ওসমান রচিত উপন্যাস “ক্রীতদাসের হাসি।” ১৯৬২ সালে তিনি এ উপন্যাসটি রচনা করেন। এটি একটি প্রতীকধর্মী উপন্যাস। আরব্য-উপন্যাসের একটি কল্পিত কাহিনির মাধ্যমে সমকালীন জীবন তথা আয়ুব খানের সামরিক শাসনে লাঞ্ছিত সমাজের চিত্র উপন্যাসটিতে মনোরমভাবে অঙ্কিত হয়েছে।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানকে বর্বর স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে আবদ্ধ করলো। এ সময় সব ধরনের-বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্থানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে এ উপন্যাস রচিত হয়। এ উপন্যাসের মূল চরিত্র তাতারী। গণতান্ত্রিক চেতনাকে ভয় পায় স্বৈরাচারী শাসক। এই চেতনাকে দমন করার জন্যই আবার নেমে আসে সামরিক শাসন তবুও লেখকের প্রতিবাদ স্তব্ধ থাকেনি। রূপকের মধ্য দিয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে এই প্রতিবাদ। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’র তাতারী। খলিফা হারুনর রশীদ কোনো কিছুর বিনিময়েই তাতারীর হাসি শুনতে পান না। খলিফার নির্দেশে হাসার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছে তাতারী।
গণতান্ত্রিক চেতনায় যখনই কেউ সোচ্চার হয়েছে তখনই স্বৈরশাসকরা তা কঠোর হাতে দমন করেছে। এবং এই প্রথা চলতে থাকে যুগ যুগ ধরে, প্রতিবাদ যে কেউ করে না, তা কিন্তু নয়। প্রতিবাদ করে, তবে তাতে লাভের লাভ হয়না কিছুই উল্টো প্রতিবাদকারীকে চরম মূল্য গুনতে হয় সবসময়ই। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের তাতারী গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করেছে। আর বাদশাহ হারুনুর রশীদ স্বৈরশাসকের ভূমিকা পালন করেছে যেন। এই ঘটনা রুপকের মধ্য দিয়েই বিস্তৃত হয়েছে শওকত ওসমানের “ক্রীতদাসের হাসি”উপন্যাসে।
হারেমের বাদী মেহেরজানের সাথে হাবশি গোলাম তাতারীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো আগেই। নিজেদের ভালোবাসাকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত দুই ক্রীতদাসের হাসি শুনে তাদেরকে খুঁজে বের করলেন খলিফা। হাবশি গোলাম তাতারী আর বাদী মেহেরজান দুজনকেই মুক্ত-স্বাধীন করে দিলেন তিনি। কিন্তু, প্রকৃত অর্থে কেউই আসলে স্বাধীন রইলো না। তাতারীর হাসি শোনার জন্য তাকে অঢেল সম্পদ আর সেবাযত্নকারী দাস দিয়ে বাড়িতে আটকে রাখলেন খলিফা। অন্যদিকে আর্মেনীয় সুন্দরী মেহেরজানের স্থান হলো খলিফার হারেমে।
কিন্তু মেহেরজানকে হারিয়ে তাতারীর সেই উচ্ছ্বলতা হারিয়ে গেল। তার মুখে আর সেই প্রাণখোলা হাসি দূরে থাক, ঠোঁটও সামান্য বাঁকা হয়না। মেহেরজানের সান্নিধ্য তাকে যে আনন্দ দিতে পারতো, এই অঢেল সম্পদ আর এত দাসদাসী তার যৎসামান্যও দিতে পারে না। এদিকে, ক্রীতদাসের হাসি শোনানোর জন্য আবুল আতাহিয়া আর আবু নওয়াসের সাথে বাজি ধরেছিলেন খলিফা। কিন্তু মনের আনন্দ কেড়ে নেওয়ার পর সেই প্রাণখোলা হাসি কি আর তাতারীর মুখে দেখতে পাবেন খলিফা হারুন-অর-রশিদ? তাতারীর প্রাণখোলা হাসি শোনাতে না পারায় অপমানিত খলিফা সিদ্ধান্ত নিলেন কেন এই হাবশি গোলাম আর আগের মতো হাসতে পারছেন না, কোন উপাদানটির অভাব ঘটছে তা অনুসন্ধান করবেন।
তাতারীর মনোরঞ্জনের জন্যেও পাঠালেন সারা বাগদাদের সবচেয়ে সেরা সুন্দরী বুসায়নাকে। সেই বুসায়না ও ব্যর্থ হয়। মেহেরজান থেকে আলাদা হয়ে তাতারি কি হাসতে পারে! না পারেনি তাতারি। ক্রুদ্ধ খলিফার নির্দেশে চাবুকের আঘাত তাতারির কালো চামড়া ফালি ফালি হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছে। কিন্তু হাসি ফিরে আসেনি।
ক্ষত-বিক্ষত তাতারীকে চাবুক মারা হচ্ছে, তাতারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে এবং বলছে-
“শোন হারুনুর রশীদ,
দীরহাম দৌলত দিয়ে
ক্রীতদাস গোলাম
কেনা চলে, বান্দী
কেনা সম্ভব! কিন্তু…
কিন্তু ক্রীতদাসের
হাসি? না! না! না!
না!”
(ক্রীতদাসের হাসি, শওকত ওসমান, প্রকাশক : সময় প্রকাশন)
-তাসফিয়া তাসমিন মিশু