১৯শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, রাত ৩:১০

জোছনা ও জননীর গল্প

লেখক
মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ২০২১

মুক্তিযুদ্ধের উপর যত উপন্যাস রচিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হুমায়ূন আহমেদের “জোছনা ও জননীর গল্প” (২০০৪)। এটি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস। এটা কোন ইতিহাসের বই না কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ এমন একটা উপন্যাস রচনা করেছেন যা ইতিহাসের আদলে গড়া উপন্যাস।এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাসের অবরুদ্ধ, আহত, যন্ত্রণাদায়ক নির্মম বাস্তবতা উপস্থাপিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে হুমায়ুন আহমেদ আটটি উপন্যাস লিখেছেন। “শ্যামল ছায়া”, “নির্বাসন”, “১৯৭১”, “সৌরভ”,” আগুনের পরশমণি”, “সূর্যের দিন”, “অনিল বাগচির একদিন” এবং “জোছনা ও জননীর গল্প।” প্রত্যেকটি উপন্যাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতাকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। একসময় তিনি উপলব্ধি করলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের কাহিনি নিয়ে একটা উপন্যাস রচনা করা দরকার।তিনি নিজেই বলেছেন-

“এক সময় মনে হল   মুক্তিযুদ্ধের পুরো  সময় ধরে রাখার  জন্য একটা উপন্যাস লেখা  উচিত। মানুষকে  যেমন পিতৃঋণ-মাতৃঋণ  শোধ করতে হয়,  দেশমাতার ঋণও শোধ করতে হয়। একজন লেখক সেই ঋণ শোধ করেন      লেখার মাধ্যমে।” ( পূর্বকথা : হুমায়ূন  আহমেদ/জোছনা ও জননীর  গল্প)

দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ এ উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাস লিখতে তিনি বেশকিছু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র থেকে বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় মাধ্যমে যুদ্ধের ৯ মাসের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন নিপুণভাবে। সব জায়গাতেই লেখক তথ্যসূত্র ব্যবহার করেছেন।এটি এ উপন্যাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। “জোছনা ও জননীর গল্প” উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কোন এক রাত থেকে এবং শেষ হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে।এ উপন্যাসে  হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক নানা ব্যক্তিবর্গ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, কবি, শ্রমজীবী, নির্যাতিত-নিপীড়িত নানা ধরনের চরিত্রের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। উপন্যাসে বাস্তবিক চরিত্র যেমন উপস্থিত, পাশাপাশি কাল্পনিক চরিত্রের উপস্থিতিও লক্ষ করা যায়।তবে কাল্পনিক চরিত্র গুলোও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।এ ধরনের চরিত্রের মধ্যে শাহেদ, আসমানী, রুনি, মরিয়ম, নাইমুল, মাসুম, কলিমোল্লা, গৌরাঙ্গ, নীলিমা, আসগর আলী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, টিক্কা খান, ইয়াহিয়া খান,আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, এম এ জি ওসমানী, জগজিৎ সিং অরোরা, কাদের সিদ্দিকী, মেজর জেনারেল নাগরা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

“জোছনা ও জননীর গল্প” উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাসের রক্তক্ষরণ স্থান পেয়েছে। ০১ মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা, ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, পল্টনের ময়দানে মাওলানা ভাসানীর ভাষণ, ২৫শে মার্চের ভয়াল কালোরাতের চিত্র ও হত্যাকাণ্ড, সুইপারদের জবানীতে নির্মমতার বর্ণনা, মুজিবনগর সরকার গঠন, যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম, ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা এবং ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জনের কাহিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন এ উপন্যাসে। এর মাঝে আছে বঙ্গবন্ধুর অবদান, মেজর জিয়ার অবস্থান, কাদের সিদ্দিকীর অপারেশন, যোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশন, পাকবাহিনীর হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের নৃশংসভাবে মৃত্যু হওয়া, পাক বাহিনী কর্তৃক অসংখ্য নারীর ইজ্জত লুণ্ঠন, ক্যাম্পে আটকে রেখে দিনের-পর-দিন শারীরিক নির্যাতন কোন কিছুই বাদ পড়েনি এই উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হলে এই বইটি পড়া একান্ত প্রয়োজন।

 

(জোছনা ও জননীর গল্প, হুমায়ূন আহমেদ, প্রকাশক-অন্যপ্রকাশ)

– তাসফিয়া তাসমিন মিশু


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো